,

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বিদ্যুতায়নের নির্দেশ প্রতিমন্ত্রীর

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেছেন, উৎপাদন, বিতরণ ও সঞ্চালনের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিতে হবে।

প্রতিমন্ত্রী বৃহস্পতিবার তার বাসভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিভাগ, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল), পাওয়ারজোন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড (এএসপিসিএল), ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি), নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিওপিজিসিএল), কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল), বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি) ও পাওয়ার সেলের সঙ্গে চলমান প্রকল্পের অগ্রগতি ও বাস্তবায়ন এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে পর্যালোচনা সভায় উল্লিখিত নিদেশ দেন প্রতিমন্ত্রী।

সভার প্রথমেই বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো), নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি ও দ্রুত বিদ্যুতায়ন নিয়ে আলোচনা করা হয়।

ওই সময় প্রতিমন্ত্রী বলেন, যে সমস্যাই হোক না কেন অতিদ্রুত বিদ্যুতের ব্যবস্থা করুন। হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনে জেনারেটর সরবরাহ করে বিদ্যুতায়নের উদ্যোগ নিন। সার্বিক পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগকে নির্দেশ দেন তিনি।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, জাপান মাতারবাড়ীতে তৃতীয় ও চতুর্থ ইউনিট করার অনুমোদন দিয়েছে। উন্নয়নের গতি চলমান রাখতে হবে। নিরাপত্তার বিষয়ে আপস করা যাবে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান অবশ্যই স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রদত্ত কোভিড-১৯ সংক্রান্ত গাইডলাইন ও নির্দেশিকা অনুসরণ করে কাজ করবে।

ভার্চুয়াল এ সভায় অন্যান্যের মধ্যে বিদ্যুৎ সচিব ড. সুলতান আহমেদ, পিডিবির চেয়ারম্যান মো. বেলায়েত হোসেন, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া ও কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বুধবার রাতে ঘূর্ণিঝড়টি যখন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে উত্তরবঙ্গের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন দুই কোটি ২০ লাখের বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, যা দেশের মোট গ্রাহকের প্রায় ৬০ শতাংশ।

ঝড়ের তীব্রতা কমার পর বৃহস্পতিবার ভোর থেকে দুর্গত এলাকায় সংযোগ পুনঃস্থাপনের কাজ শুরু করে বিতরণ সংস্থাগুলো। তবে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত লক্ষাধিক গ্রহকের বিদ্যুৎ ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি।

এর মধ্যে গ্রিড সাব স্টেশনে আগুন লাগায় কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলা দীর্ঘ সময়ের জন্য বিদ্যুৎহীনতার কবলে পড়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

দেশে ছয়টি বিতরণ সংস্থার অধীনে রয়েছে তিন কোটি ৬৫ লাখ বিদ্যুৎ গ্রাহক। তার মধ্যে এক কোটি ২০ লাখের বেশি গ্রাহকের সংযোগ বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত বন্ধ বা বিচ্ছিন্ন থাকায় চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াট থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসে।

বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় সচল এলাকাগুলোতে বিদ্যুতের ভোল্টেজ বেড়ে যায়। ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে আরও অনেক এলাকায় সরবরাহ বন্ধ রাখা হয় বলে বিতরণ সংস্থাগুলো জানিয়েছে। সরবরাহ ব্যবস্থার এই বিপর্যয়ের মধ্যে অনেক উৎপাদন কেন্দ্রও বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির হিসাব অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ভোর ৫টায় সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা দুই হাজার ৬৮৩ মেগাওয়াটে নেমে আসে। দিনের প্রথমাংশে কিছু সংযোগ পুনঃস্থাপন করা হলেও বেলা ১টা পর্যন্ত চাহিদা সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াটের উপরে ওঠেনি।

নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত মার্চের শেষ দিকে সারা দেশে অবরুদ্ধ করার সময় বিদ্যুতের চাহিদা নেমেছিল সর্বনিু ছয় হাজার মেগাওয়াটে। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে হতে চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াটে ওঠে।

সারা দেশে পল্লী বিদ্যুতের মোট গ্রাহক সংখ্যা দুই কোটি ৮৫ লাখ। তার মধ্যে প্রায় দুই কোটির সংযোগ সকালের দিকে বন্ধ ছিল জানিয়ে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অনজন কান্তি দাশ বলেন, দুপুর পর্যন্ত এক কোটি গ্রাহকের বিদ্যুৎ ফেরানো সম্ভব হয়েছে। ২৫ হাজার স্পটে তার ছিঁড়ে পড়েছে। তিনশ’ মতো খুঁটি ভাঙার খবর পেয়েছি, সংখ্যাটা আরও বাড়ছে। প্রায় ৪০ হাজার গ্রাহকের মিটার ভেঙে গেছে।

এছাড়া কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, যশোর, পটুয়াখালী জেলা পুরোপুরি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে জানিয়ে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে। সেখানে বিদ্যুৎ ফিরতে সময় লাগবে বলে তাদের মনে হচ্ছে। তবে ভোলা, বরিশাল, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, পিরোজপুর জেলায় বিদ্যুৎ ফিরেছে।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) জনসংযোগ শাখার পরিচালক এবিএম বদরুদ্দোজা সুমন বলেন, ‘কুষ্টিয়া ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড সাব স্টেশনে আগুন লেগে দুটি ট্রান্সফরমার জ্বলে গেছে। কুষ্টিয়াসহ পাশের কয়েকটি জেলায় দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে। তবে খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলায় কোনো সমস্যা হয়নি। সেখানে বিতরণ সংস্থাগুলো লোড কমিয়ে দেয়ার কারণে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। তারা যখনই চাইবেন বিদ্যুৎ পাবেন।’

রাজশাহীর আট জেলার বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (নেসকো) এমডি প্রকৌশলী জাকিউল ইসলাম বলেন, চাহিদা কমে যাওয়ায় জেলার ৪৪টি ৩৩ কেভি ফিডারের সবই বন্ধ করতে হয়েছিল। দুপুর পর্যন্ত ৩০টি চালু করা গেছে। বাকিগুলো চালু করতে কিছুটা সময় লাগছে। তবে হাই ভোল্টেজের কারণে সচল ফিডারগুলোতে বিদ্যুৎ দেয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে ৮০ শতাংশ সংযোগে কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তবে হাতিবান্ধা-পাটগ্রামে এখনও ঝড়বৃষ্টি থাকায় সেখানে অবস্থিত একটি ফিডারে কাজ করা যাচ্ছে না।

ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক উদ্দিন জানান তাদের, মোট ১২ লাখ গ্রাহকের প্রায় সবাই ঝড়ের সময় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। দুপুর পর্যন্ত সর্বোচ্চ ছয় লাখ গ্রাহকের মাঝে বিদ্যুৎ দেয়া গেছে। কিছু লাইন সচল হলেও ১১ কেভি ফিডার সচল করতে না পারায় বিদ্যুৎ দেয়া যাচ্ছে না। এছাড়া ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া এবং বরগুনায় বিদ্যুৎ দেয়া যায়নি দুপুর পর্যন্ত। এসব এলাকায় মেরামত কাজ চলমান আছে।

বিদ্যুতের একক ক্রেতা ও বিক্রেতা পিডিবির হাতে রয়েছে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট ও কুমিল্লার শহরাঞ্চলের বিতরণ ব্যবস্থা। এসব এলাকায় গ্রাহক রয়েছে প্রায় ৩০ লাখ। পিডিবির জনসংযোগ শাখার পরিচালক সাইফুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘ঝড়ে পিডিবির বিতরণ লাইনে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও ময়মনসিংহে কিছু লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেগুলো দিনের মধ্যেই মেরামত করা সম্ভব হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর