,

ক্ষতি পোষাতে অনলাইনে দীর্ঘমেয়াদি পাঠদান

বিডিনিউজ ১০ ডেস্ক: সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ছয় সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও এরই মধ্যে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক শিক্ষাপঞ্জি। এ অবস্থার মধ্যে করোনাভাইরাসের দুর্যোগ পুরোপুরি না কেটে যাওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ইঙ্গিত দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এরপরই গতকাল শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নতুন করে কাজ শুরু করেছেন।
কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরও তিন থেকে চার মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা অনলাইনেই চালিয়ে নেওয়া হবে। এ জন্য অনলাইন সাপোর্ট আরও বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সিলেবাস কাটছাঁট করার বিষয়টিও বিবেচনাধীন।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সবকিছু এখনও চিন্তাভাবনা পর্যায়ের। মাধ্যমিকে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা বাতিল করা হলেও জুন মাসে অনলাইনে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ করা যায় কিনা, তা ভাবা হচ্ছে। তবে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা এভাবে নেওয়া যাবে না বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। সবার অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়ার মতো সাপোর্ট নেই।

শিক্ষাবিদরা মনে করেন, বর্তমান অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ দীর্ঘায়িত করার সরকারি সিদ্ধান্ত পুরোপুরি যৌক্তিক। তবে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ঘরে অভিভাবকদের নিজ সন্তানকে সাপোর্ট দিতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদেরও আন্তরিকতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নেওয়া ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তাদের একাডেমিক সমস্যার সমাধান করে দিতে হবে।

গতকাল সোমবার রাজশাহী বিভাগের আট জেলার খোঁজখবর নিতে ভিডিও কনফারেন্সের শুরুতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ অবস্থায় নতুন করে দুর্ভাবনায় পড়েছে সারাদেশের বিভিন্ন স্তরের সাড়ে ৫ কোটি শিক্ষার্থী। অন্যদিকে ১৩ লাখ এইচএসসি পরীক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে তাদের পরীক্ষা কবে হতে পারে।

এ প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা সচিব ও শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানরা সমকালকে বলেছেন, পরীক্ষার সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ এখনই বলা সম্ভব নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুললে এ পরীক্ষা নেওয়া যাবে না।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বিপাকে রয়েছেন এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। গত ১ এপ্রিল থেকে এ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। পরে পরীক্ষা স্থগিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

গতকাল এ পরীক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, পরীক্ষা নিতে হলে অবশ্যই আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে হবে। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই পরীক্ষার ভেন্যু। যতদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব না হচ্ছে, ততদিন পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়। সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হলে, এর ১৫ দিন পর এইচএসসি-সমমান পরীক্ষা আয়োজন করা হবে। একই কথা জানিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে কোনোভাবেই এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসএসসি পরীক্ষার ফলও প্রকাশ করা হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেমিস্টার ফাইনাল আটকে আছে। প্রাক প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই হুমকির মুখে পড়েছে। বিপাকে পড়েছে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাও। সারাবিশ্বে একই দিনে অনুষ্ঠিত হয় তাদের বোর্ড পরীক্ষা। করোনা প্রাদুর্ভাবের বর্তমান পরিস্থিতিতে অ্যাডেক্সেল ও ক্যামব্রিজের অধীনে চলতি বছরের মে-জুনের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী জুনে অনুষ্ঠেয় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর বার্ষিক পরীক্ষাও প্রয়োজনে অনলাইনেই গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে একাধিক স্কুল কর্তৃপক্ষ।

গ্রিন জেমস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ ড. জি এম নিজাম উদ্দিন বলেন, আগামী মে-জুনের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা এবার হবে না। এর পরিবর্তে স্কুল বেসড অ্যাসেসমেন্ট করা হবে। শিক্ষার্থীরা সারাবছর যে পড়ালেখা করছে এর ওপর স্ব স্ব স্কুল তাদের মূল্যায়ন করে গ্রেড দেবে। এরপর সেটি পাঠানো হবে ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষা বোর্ডে। সেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ডাটা রয়েছে। স্কুলের আগের বছরগুলোর ফল রয়েছে। সবকিছু অ্যানালাইসিস করে ইন্টারন্যাশনাল বোর্ড প্রত্যেক শিক্ষার্থীর গ্রেড ঠিক করবে।

চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের সময়সীমা গত ৩ এপ্রিল পার হয়ে গেছে। পরীক্ষা শেষের ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই পরীক্ষার্থীদের বিষয়ে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মোকবুল হোসেন বলেন, ফল প্রকাশের সময়সীমা ৩ এপ্রিল ছিল। এরপর আন্তঃশিক্ষা বোর্ড থেকে আমরা ৬ ও ৭ এপ্রিল ফল প্রকাশের সম্ভাব্য সময়সীমা ঠিক করেছিলাম। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে সরকারি ছুটি বাড়াতে হওয়ায় সব এলোমেলো হয়ে গেল। এখন কবে ফল প্রকাশ করা হবে তা অনিশ্চিত।

জানা গেছে, যশোর শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ তাদের বোর্ডের সব পরীক্ষার্থীর অভিভাবকদের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করেছে। তারা করোনার ছুটিতেই ফোনে ফল প্রকাশ করতে চায়। তবে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড এভাবে ফল প্রকাশে সায় দেয়নি।

সরকারের ভাবনা :এদিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ঝিমিয়ে পড়া শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে বেশ কিছু বিকল্প ভাবছে সরকার। এর মধ্যে সিলেবাস থেকে ক্লাস ও পরীক্ষা কমিয়ে আনার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ সমকালকে জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা ইতোমধ্যে স্থগিত করা হয়েছে। এ পরীক্ষা ১৫ থেকে ২৪ এপ্রিল হওয়ার কথা ছিল। যদিও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য টেলিভিশনে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। যারা টেলিভিশনে ক্লাস করতে পারছে না, তারা ওয়েবপোর্টালের মাধ্যমে সেসব ক্লাস করতে পারছে। তার পরও কিছু শিক্ষার্থী এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকছে। তাদের কথা চিন্তা করে বিদ্যালয় খুললে সেসব ক্লাস সংক্ষিপ্ত আকারে শিক্ষকরা রিভিশন দেবেন। তিনি আরও বলেন, পরিস্থিতি অনুকূলে এলে বন্ধের দিনগুলোতে পরীক্ষা-ক্লাস নিয়ে সমন্বয় করা হবে। আর যদি তা না হয় তবে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করতে হবে। ক্লাস-পরীক্ষা কমিয়ে ২০২০ শিক্ষাবর্ষ শেষ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

অন্যদিকে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে পাঠদান কার্যক্রম অন্তত ছয় মাস পিছিয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সিলেবাসের ক্লাস-পরীক্ষা কমিয়ে শিক্ষাবর্ষ শেষ করতে একটি নতুন পরিকল্পনা করার জন্য তারা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক জানান, সাধারণ ছুটির মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সিলেবাস পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে না। তবে এটি আরও দীর্ঘায়িত হলে, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা হতে পারে।

শিক্ষাবিদদের মতামত :শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ দীর্ঘায়িত করাই যৌক্তিক। ইউরোপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ। আমি মনে করি, করোনা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ আগে জরুরি। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা ভাবা যাবে। হোক সেটা সেপ্টেম্বর বা আরও পরে। প্রতিষ্ঠান খুলেই শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে হবে। অনলাইন শিক্ষা এদেশে তেমন কার্যকর নয়, কেউ অভ্যস্তও নয়।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার আগে জীবনের মূল্য বড়। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘরে থাকা শিক্ষার্থীদের সাপোর্ট দিতে অভিভাবক ও শিক্ষকদের এগিয়ে আসা জরুরি।

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, আমেরিকায়ও সব স্কুল-কলেজ বন্ধ। হার্ডার্ড এখনও খোলেনি। তারা সবকিছু ধীরে ধীরে খুললেও স্কুল-কলেজ বন্ধই রেখেছে। আমরাও নতুন প্রজন্মকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারি না। এ দেশে সরকারের সিদ্ধান্ত সঠিক। তরুণরাই আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। তিনি বলেন, অনলাইন, টেলিভিশনের পাশাপাশি বেতারের এফএম ব্যান্ড ও কমিউনিটি রেডিওতে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে হবে। বেসরকারি খাতের এক্ষেত্রে এগিয়ে আসা জরুরি।

উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, ‘আরও কতদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে, কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সেটা আগে নিরূপণ করতে হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় খুললে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে ক্ষতি পোষানো যেতে পারে। কিন্তু ক্লাস না নিয়ে, সময় না দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া যাবে না।’

এই বিভাগের আরও খবর